রাতের হাসনা হেনা
লেখকঃ সাঈদা নাঈম
“সাঈদা নাঈম” লেখকের অন্য লেখাগুলো পড়তে লিংকে ক্লিক করুন।
সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে একটা ক্যাবে উঠে বসলো মায়া। দিনের কড়কড়ে রোদ, মানুষ যেন পাপড় হয়ে যাবে এমন অবস্থা। তাই খরচ একটু বেশি হলেও উবার কল করেছে মায়া। প্রথম প্রথম এ খরচটা করতে কষ্ট হতো। এতোগুলো টাকা ভাড়া! কিন্তু এখন আর লাগে না। ওর জীবনে ছিল মা আর ছোট ভাই। ওদের জন্য উপার্জনের সব টাকা রাখতো। মা মারা গেলেন বছরখানেক হলো আর ভাইকে চেষ্টা করে পাঠিয়ে দিলো বিদেশ। যাওয়ার সময় ভাইকে বলেছিল, “এই দেশে আর আসিস না রবিন। বিদেশে বিয়া কইরা থাইকা যাইস। কেউ নাই এইখানে আমাগো। “
রবিন বলেছিল, আপা, আমার তো তুমি আছো।
ভাইকে বুঝায় মায়া, “আমার কথা কারো কাছে বলবি না। আমার পরিচয় দিলে তোর ভবিষ্যৎ শ্যাষ। ফোন করিস যখন মনে হইবো। “রবিন বোনের কথা শুনে বলে, ভবিষ্যৎ গইড়া দিলা তুমি আর তুমিই কও শ্যাষ করছো তুমি! আসলে সবই সমাজ। দোষ তোমার না। “চলে যায় ভাই।
এরপর থেকে মায়া স্বাধীন। সবার সমাধান হয়েছে কিন্তু এ পেশা থেকে আর ফেরার পথ নেই। কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? চালিয়ে যাচ্ছে সব যেমনটি আগে ছিল।
এ পৃথিবীর মায়ারা রাতে ফোটে, সুভাস ছড়ায়। দিনে দুর্গন্ধ শুধু ওদের শরীরে থাকে। স্বাভাবিক জীবন কাকে বলে সেটি যাপন করা এদের জন্য স্বপ্ন। সুন্দরী হলে গরীব ঘরের মেয়েরা এখানে এসে হয়ে যায় রাণী দালালদের খপ্পরে পড়ে। এখানে বেশীরভাগ মেয়েরাই ধোকা খেয়ে এখানে এসেছে। স্বেচ্ছেয় কেউ অস্বাভাবিক জীবন বেছে নেয় না।
হঠাৎ কে যেন বলল, ম্যাডাম ডানে যাবো নাকি বাম দিকে? হাউস নম্বর কত?
সম্বিত ফিরে পায় মায়া। ও যাচ্ছে এক বিশাল বড়লোকের বাড়ি। বউ আর ছেলে মেয়েরা দেশের বাইরে গিয়েছে। হঠাৎ শখ হয়েছে কোনো মেয়ের সঙ্গ প্রয়োজনের। মায়াকে আগে চিনতো ওকে বেশি টাকা দিয়ে বাসায় ডেকে নিয়ে এসেছে।
যথারীতি নির্ধারিত ফ্ল্যাটে এসে ডোর বেল চাপলো মায়া। বেশ হ্যান্ডসাম একজন পুরুষ দরজা খুলে দিলো। মায়া ভিতরে গেল। বৈভব ঘরে প্রবেশ করেই বুঝা গেল। আর এ ঘরের গৃহিনীও খুব সৌখিন বোঝা গেল। দেয়ামে বেশ বড় সাইজের ফ্রেমে পরিবারের ছবি ঝুলানো। ভদ্রলোক সুখে আছেন বোঝা গেল। এরপরও কেন মায়াকে ডাকলেন ভেবে পায় না। মানুষের কত শখ! মায়া মনে মনে বলল, আমার কি? আমার দরকার টাকা, তার দরকার সঙ্গ। এখন কি ধরনের সঙ্গ চাইছেন ভদ্রলোক উনিই জানেন।
হ্যাঁ, এখন পর্যন্ত উনি ভদ্রলোক। মায়ার সঙ্গে এখন পর্যন্ত এমন কোনো আচরণ বা কথা বলেননি যে তাকে ভদ্রলোক বলবেন না। মায়াকে নাস্তা দিলেন নিজেই। মায়ার অস্বস্তি লাগছে। সাধারণত যারা ডেকে নেয় তারা মদ খেয়ে টাল হয়ে থাকে। অথচ এ লোকটি ওর দিকে মিষ্টির প্লেট তুলে দিতে দিতে বললেন, তুমি খুব সুন্দর মায়া। তুমি কি জানো?
হ্যাঁ, জানি। সুন্দর দেখেই তো আমাকে ডেকে নিয়ে আসেন আপনারা। এখন বলেন নাস্তা খাওয়ার পর কোন রুমে যেতে হবে। কাজ করে টাকা ইনকাম করি। এখানে কাজ করতে এসেছি। হ্যাঁ, তা ঠিক। তোমার কাজ শুরু হয়ে গেছে। আমার সাথে কথা বলাটাও তোমার কাজের অংশ।
আচ্ছা সিনেমার গল্পের মতো তোমার এটি ছদ্মনাম নয় তো? থাকলে বলো।
মায়া জানালো, এটিই তার নাম। নাম পাল্টিয়ে কি হবে?
নাম পাল্টালেও আজ এখানে থাকতে হতো, না পাল্টিয়েও এখানে। মায়ার শরীরের বাঁধুনি ভালো। ব্যবহার ভালো। দেখতে সুন্দর। তাই যে কেউ আকৃষ্ট হয়ে যায় ওকে দেখে। এ কাজ হলেও তো কাজ, চুরি না। কাজ করে টাকা রোজগার করে।
কাজ করা একটা হাতব্যাগ নিয়ে এসেছিল, সেটি সোফার একপাশে রাখলো মায়া। এরপর বলল, কি গল্প শুনবেন? বলুন? আমার এ কাজ কেন করা, কিভাবে আসা?
শোনেন সাহেব, সিনামা না হলেও এ জীবনের গল্প সবার এক। কেউ শখ করে আসে না। এটা যেমন আমি জানি, তেমনি আপনিও জানেন। আর কি গল্প করবো? তবে হ্যাঁ, আপনার স্ত্রীর বদনাম আমার সঙ্গে করতে পারবেন না। আপনার স্ত্রী খুব ভালো মানুষ।
লোকটি বিস্ময়ে জানতে চাইলো –
তুমি কেমন করে বুঝলে?
আপনার ফ্ল্যাটে ঢুকেই বুঝেছি। আপনার স্ত্রী অনেক সৌখিন, সাংসারিক এবং রোমান্টিক। আর হ্যাঁ, আপনিও ভালো মানুষ। স্ত্রীকে ভালোবাসেন। কিন্তু এসব পরীক্ষা, নিরীক্ষা করা আপনার উচিত না।
মানে!
আপনি আমাকে ডেকে এনেছেন আমার জীবনের গল্প শোনার জন্য, আর রাত কিভাবে কাটাই সেটা দেখার জন্য। আপনি আমাকে এনেছেন। গল্প করেন আর যা ই করেন, পেমেন্ট পেলেই হলো। এই বলে একটি সিগারেট ধারালো। লোকটিকেও অফার করলো।
দুজনে সিগারেট খাচ্ছে। ধীরগতিতে কথা চলছে। লোকটি মায়াকে যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে। ওর রূপের প্রশংসা আগেই শুনেছে এক বন্ধুর কাছ থেকে। কিন্তু ও যে এতো বুদ্ধিমতী তা জানেনি। সম্ভবত কেউ জানে না। সবাই তো রাত কাটায় ওর শরীর নিয়ে আনন্দ করার জন্য, গল্প করার জন্য নয়। ওর সঙ্গে গল্প করে ভালো লাগছে। রাতের খাবার অনেক কিছু এনে ছিল কিন্তু মায়া বেশি কিছু খেলো না। টেবিল থেকে পছন্দের মতো ভাত আর ভর্তা, ডিম ভুনা নিলো। লোকটি বলল, গোশত নাও, এই যে বড় চিংড়ি এনেছি তোমার জন্য এটা নাও।
মায়া ভাত মাখাতে মাখাতে বলে, একদিন এতো ভালো মন্দ খেয়ে কি হবে? প্রতিদিন নিজের টাকায় এর চেয়েও কম খায়। একটা তরকারি দিয়ে খায়। ওখানে নিজের রান্না নিজে করে খাওয়ার ব্যবস্থা। খুব বেশি হলে মাঝে মধ্যে ডিম ভুনা করে। মায়া বলল, আপনি খান আর কথা বলেন। আচ্ছা আমি বলি, ঐ যে দেয়ালে ছবি টানানো আপনার বউ আর ছেলে মেয়ে?
লোকটি বলল, হ্যাঁ।
খুব সুন্দর সবাই। আপনার বউ কোথায় গেছে? বাপের বাড়ি?
লোকটি জানালো, অস্ট্রেলিয়া গেছে ছেলে মেয়ের কাছে। কয়েকদিন থাকবে।
এই সুযোগে আপনি আমারে ডেকে আনছেন। আপনার বউ যদি জানতে পারে!
জানতে পারবে না। দাড়োয়ান ছুটি নিয়েছে। সারা বাড়িতে আমি ছাড়া কেউ নেই।
ওওওও। বুঝছি।
খাওয়া শেষ দুজনের। লোকটি বলল একটু বসো। কফি খেতে খেতে গল্প করি। মায়াও বলল আনেন। গল্প যখন করতেই হবে, জেগে থাকতে চা কফি লাগবে।
মায়া শুদ্ধ – অশুদ্ধ মিলিয়ে কথা বলে। চেষ্টা করে পুরোটা শুদ্ধ বলতে কিন্তু চলে আসে অশুদ্ধ কথা। টুকটাক ইংরেজীও বলে। নিশিরাতের রাজকন্যা হয়ে অনেক কিছু শিখেছে মায়া। অনেক মাতালকে ম্যানেজ করতে পারে যা অন্য কেউ পারে না। মাতালরা ঘরে আসলে সেই রাতে মায়া ঘুমাতে পারে। কারণ ঐ মাতালদের আরো মদ খাইয়ে বিছানায় ধাক্কা দিয়ে শুইয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে কথা বলতে বলতে ঐসব মাতাল নিজেরাই ঘুমের ভোগে চলে যায়। সারারাত আর ওঠে না। প্রথম প্রথম এসব মাতাল ঘরে ঢুকলে ওর মেজাজ বিগড়ে যেত। তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার জন্য মায়া ওদের চাহিদা মেটানোর জন্য রেডি হতো। কিন্তু মাতালরা শুধু লম্ফঝম্ফ করতো। যে কাজের জন্য টাকা দিয়ে এসেছে সেই কাজই করতে পারতো না। নিস্তেজ মানুষ, মেয়ে মানুষ ভোগ করার ক্ষমতা এদের নাই। আর কোন কৌশলে এদের হাত থেকে অবসর পাওয়া যায় সেটি মায়া রপ্ত করে নেয়। এরপর থেকে আর মাতাল দেখলে বিরক্ত হয় না। বরং রাতের ঘুমটা হবে এ ভেবে খুশি হয়। এদের কামবাসনা জাগে কিন্তু এরা একবার বিছানায় পিঠ ঠেকাতে পারলেই ঘুমিয়ে যায়। রাত শেষ হলেই তো টাকা। ওর তো কোনো দোষ নেই।
অনেক সময় ওর ইচ্ছে না হলে অনেককে মদের সাথে ঘুমার ট্যাবলেট দিয়ে দেয় আগোচরে। ঘুমা আর আমাকেও ঘুমাতে দে, মনে মনে মায়া ভাবে।
সকালে তো এদের মনেই থাকে না, রাতে কি হয়ছে আর কি হয়নি। বেচারা না এরা গাধা আর ঠকবাজ। মায়াদের খারাপ বলে! ওরাই খারাপ। এসব জায়গায় ভালো মানুষ আসে?