Homeগল্পঠাকুরগাঁওয়ের পথে

ঠাকুরগাঁওয়ের পথে

ঠাকুরগাঁওয়ের পথে

লেখকঃ তৌফিক মিথুন

ঘটনাটা প্রায় বছর দশেক আগের। আমাদের গ্রামের এক লোক আঞ্জুমানে মফিদুলের গাড়ি চালাতো। নাম বললে অনেকেই হয়তো চিনবেন। আমাদের হরিপদ কাকা।

মৃত লাশ নিয়ে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন জেলায় তার যাওয়া লাগতো। একদিন বিকালে অফিসের নিচে চা খাচ্ছিলেন। তখন পিয়ন জালাল মিয়া গিয়ে খবর দেয় একটা মৃত লাশ নিয়ে তাকে ঠাকুরগাঁও যেতে হবে।

কাকা দেখল লাশটাকে। লাশটা একটা মেয়ের, খুব সুন্দরী। মনে হয় কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। খুব বাজে ভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছে। মাথার এক পাশ থেঁতলানো, চুলগুলা এলোমেলো। দেহের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্ত ঝড়ছে। উনাকে প্রায়ই এমন লাশ নিয়ে অনেক জেলাতে যেতে হয়। তাই দেরী না করে দ্রুত সাথে একজন কে নিয়ে রওনা দিলেন।

উনি যখন রওনা দিচ্ছিলেন, তখন সন্ধ্যা হয় হয় অবস্থা। তখন রাস্তা ঘাটের অবস্থাও এখনকার মত ভালো ছিলো না। একটানা চার,পাচ ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে একটা স্থানে এসে কিছু খাওয়ার জন্য গাড়ি থামালেন। খেয়ে দেয়ে আবার যখন রওনা দিলেন তখন রাত প্রায় এগারোটা। ঐ অঞ্চলের জন্য গভীর রাত। রাস্তার এদিকটায় খুব একটা গাড়ির চলাচল নেই।

কয়েক কিলোমিটার এগোনোর পর হঠাৎ একটা চাকা বিকট শব্দে বাস্ট হয়ে যায়। গাড়ি থেকে নেমে দেখলেন পেছনের চাকা বাস্ট হয়ে গেছে। এক্সট্রা চাকার জন্য গাড়িতে খোজ করে দেখেন, তারাহুরোতে উনার এসিসটেন্ট এক্সট্রা চাকা নিতেই ভুলে গিয়েছে।

এসিস্টেন্টের নাম ছিলো সুবল। সুবল বলল দাদা, চাকা যেহেতু নাই আমরা যেখানে খাওয়া-দাওয়া করছিলাম, ওইখানে যাই দেখি চাকা সারাইতে পারি কিনা? হরিপদ কাকার কাছে এ কথা মানা ছাড়া আর কিছু করার মতও ছিলো না। তাই সুবলকে কিছু টাকা আর নষ্ট চাকাটা দিয়ে ঐ দোকানের দিকে পাঠিয়ে দিলেন।

গাড়িটা রাস্তার এক পাশে সাইড করা ছিল। কতক্ষণ লাগতে পারে এই কথা চিন্তা করতে করতে তিনি গাড়িতে গিয়ে বসলেন। এমনিতেই জায়গাটা নীরব। একটু পর পর একটা দুইটা ডিস্ট্রিক বাস সাই সাই করে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ছাড়া, আসে পাশে আর কোন মানুষজনের কিংবা জনবসতির চিহ্ন নাই। আর রাত সাড়ে এগারোটায় কে আসবে হাইওয়েতে!

উনি একটা সিগারেট ধরিয়ে একটু পরপর একটা করে টান দিচ্ছেন আর চাকা আসার ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করে লুকিং গ্লাসে চোখ রাখ ছিলেন। এভাবে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ ভেতরে থাকা লুকিং গ্লাসে উনার চোখ আটকে গেল।

উনি সাহসী মানুষ ছিলেন। দ্রুত চোখটা সরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখেন, নাহ কিছুই না, সব ঠিক আছে। আবার যখন সিগারেটে টান দিয়ে লুকিং গ্লাসের দিকে তাকালেন, তখন ভয়ে স্থির হয়ে গেলেন।

তিনি পরিষ্কার দেখলেন মেয়েটার লাশ উঠে বসে আছে। এইবার উনি ঘাড় ঘোরাতে সাহস করলেন না। শরীর কাঁপছিলো। উনার মনে হচ্ছিল যেন দাতে দাত লেগে আসবে।

হঠাৎ পিছন থেকে মেয়েটা বলে উঠল, দাদা আমি পানি খাব। পিপাসায় গলাটা ফেটে যাচ্ছে। উনি অনিচ্ছা সত্বেও পিছনে তাকিয়ে দেখেন সত্যি মেয়েটা শোয়া থেকে বসে আছে আর ওর শরীরিরের দাগগুলা নাই, থেঁতলানো দিকটা বুঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে এতক্ষণ অজ্ঞান ছিল। এখন জ্ঞান ফিরেছে।

মেয়েটা আবারও বলতে লাগল, দাদা আমার খুব পানির পিপাসা পেয়েছে, আমাকে একটু পানি দেন। মেয়েটাকে দেখতে স্বাভাবিক লাগায়, উনার ভয় একটু একটু করে কাটছিলো। উনি পাাশে থাকা পানির বোতল মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিলেন।

পানিটা পেয়ে এক নিঃশ্বাসে শেষ করে কেমন যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর উনার দিকে মুখ করে বলতে লাগল, জানেন দাদা, এই পানির জন্য আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল।

আমার ভার্সিটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়ীতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বাসস্ট্যান্ড আসি। আমি রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে একটু সামনে আগালাম। খেয়াল করতে পারিনি কখন যে একটা বাস দ্রুতগতিতে আমার সামনে এসে পরেছে।

চোখের পলকে বাসটার আঘাতে আমি সামনে পরে যাই, আর বাসটা ব্রেক করতে না পেরে আমার মাথার ঠিক বাম সাইড দিয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় আমার সমস্ত শরীরটাকে কয়েকবার রাস্তায় পিষে, টেনে কিছুদূর নিয়ে যায়। চিৎকার করে বলতে চেয়েও পারিনি, আমাকে কেউ পানি দাও। পিপাসায় আমার গলা ফেটে যাচ্ছে। আমাকে এক ফোঁটা পানি কেউ দেয় নি।

যখন একজন এসে আমাকে পানি খাওয়াতে চাইল, ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। পানির একফোটাও গলা দিয়ে নামল না, গাল বেয়ে নিচে পরে গেল। আমার নিথর দেহটা এম্বুলেন্সে তুলা হল। আমার আইডি কার্ড দেখে ভার্সিটি থেকে তথ্য নিয়ে আপনার কাছে দিল আমাকে বাড়ী পৌছে দিতে।

মেয়েটা এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু চুপ হয়ে আবার বলল, দাদা আমার আব্বা, আম্মা আর ভাই বোনকে বলবেন আমার জন্য যেন না কাঁদে আর আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাকে পানি খাওয়ানোর জন্য। আমি এখন শান্তিতে ঘুমাতে পারবো। এই কথা বলে মেয়েটা আবার শুয়ে পরে।

ঠিক তখনই তিনি জানালা দিয়ে পিঠে কারো হাতের ছোয়া পান।

যে চাকা ঠিক করতে গেছিল, সুবল এসে গিয়েছে। পিঠে হালকা ধাক্কাটা সে’ই দিয়েছে। দাদা চলেন চাকা ঠিক হয়ে গেছে। উনি সাড়া পেয়ে খেয়াল করলেন উনার পুরা শরীর ঘামে ভেজা। হরিপদ কাকা একবার পিছনে লাশের দিকে আর একবার সুবলের দিকা তাকান। সুবল কিছুই বুঝে না। চাকাটা সুবলই লাগিয়ে আবার রওনা দিতে তাড়া দেয়।

হরিপদ কাকা ভাবলেন, হয়তো উনার তন্দ্রা এসেছিলো, তাই ভুল-ভাল চিন্তা করেছেন। গাড়ি চালু করতে যাবেন এমন সময় সুবল বললো, দাদা এত ঘামছেন একটু পানি খেয়ে, চোখে মুখে পানির ছিটে দিয়ে নিন। ভালো লাগবে।

এই বলে সে পানির বোতলটা তুলে নিয়ে বললো, একী দাদা! বোতলে তো পানি শেষ। যতদূর মনে পড়ে পানি ভরেই দোকান থেকে বের হয়েছিলাম। আপনি খেয়েছেন নাকি?

হরিপদ কাকা কি বলবেন বুঝে পান না। তিনি নিজে সরে গিয়ে সুবলকে সেই যে স্টিয়ারিং-এ বসালেন, এর পর থেকে তিনি আর কোনদিন এ্যাম্বুলেন্স চালাননি।

বাংলা সাহিত্য - www.BrandBangla.org
বাংলা সাহিত্য - www.BrandBangla.orghttps://www.brandbangla.org
আমাদের ওয়েবসাইটটি দেশের গন্ডি পেরিয়ে ভারত, নেপাল, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে যেতে সক্ষম হয়েছে।
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular