শৈলর ভালোবাসার রঙ
লেখকঃ সাঈদা নাঈম
অকাল বৈধব্য কি? শৈলবালা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। মুখে অনেক বড় বড় কথা বলা সম্ভব কিন্তু বাস্তবে রূপদান! খুবই অসাধ্য।
কত সুন্দর জীবন ছিল, লম্বা সিঁথি জুড়ে সিঁদুর ছিল। সিঁদুর দিতে গিয়ে নাকের ডগায় কিছুটা সিঁদুর পড়লে সবাই মিলে কি যে হাসাহাসি করতো। সেই হাসি দেখে শৈলবালা লজ্জায় আরো লাল হয়ে যেত। এমনিতেই গায়ের রঙ ছিল দুধে আলতায় মেশানো। তাই প্রথমবার বরপক্ষ দেখে পছন্দ করে আর দেরী করেনি। প্রথম লগ্নেই বিয়ে হয়ে যায়। শৈলবালা হয়ে গেল আরেকটা পরিবারের। আচার আচরণে কথা-বার্তায় বেশ ছিল ভালো। এই অল্প বয়সেই সংসার, স্বামী পরিবার সবদিকে ছিল তার মনযোগ। কারো কোনো একটু কথা শুনতে হয়নি কখনও।
বিশ্বজিৎ ও কম ছিল না। দেখতে সুদর্শন, স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার কমতি ছিল না। পৈতৃক ব্যবসা দেখাশোনা করতো। প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে শৈলবালার প্রিয় ফুলের মালা নিয়ে আসতো। স্ত্রীর অল্প বয়সের চঞ্চলতা তাকে মুগ্ধ করতো। স্বামীর ভালোবাসায় শৈলবালা ছিল পরিপূর্ণ। কিন্তু বিধাতার খেলা, বেশি দিন ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য শৈলবালার হলো না।
হঠাৎ করেই বিশ্বজিতের জ্বর হয় একদিন। সেই জ্বর আর ভালো হয় নি। চিতার আগুনে সেই জ্বর ঠান্ডা হয়েছে। এরপর শৈলবালা একা হয়ে যায়। অবলম্বন কোলের শিশু সুবোধ। হ্যাঁ, সুবোধই বটে। পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করে শহরেই বাসস্থান গড়েছে। বছরের এক দুইবার আসে। এটুকুই। বিশ্বজিৎ মারা যাওয়ার পর পাঁচ বছরের মধ্যে শৈলবালার বাবা-মা কাশি থেকে ফেরার পথে দেহত্যাগ করেন। থাকলেন মাথার উপর শাশুড়ির হাত। শ্বশুরকে দেখেনি উনি অনেক আগেই এ জগত ছেড়ে চলে গেছেন। রেখে গিয়েছেন অনেক সম্পত্তি। যা তিনপুরুষ বসে খেলেও শেষ হবে না। তাই এ পরিবারটি কখনও আর্থিক সংকটে পড়েনি কখনও। কিন্তু বিধাতার কি লীলা!
এই শাশুড়িও চলে গেলেন এ জগতের মোহ ছেড়ে। রয়ে গেল শৈলবালা একা। অল্প বয়সে বিয়ে হলেও ধীরে ধীরে সবকিছু শাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে শিখে নিয়ে ছিল। তা নিয়েই চলে যাচ্ছে। সব আছে। এরপরও কিছুই নেই। শুধু আছে একাকিত্ব। কাজের লোক, মালি, রাঁধুনি সবাই আছে যার যার মতো। সময় কাটে না শুধু ওর। সময়ের কি দোষ? সময় কাটানোর জন্য পরিবেশ, মানুষ প্রয়োজন। সেটি নেই।
কতইবা বয়স এখন শৈলবালার? চল্লিশ কি বিয়াল্লিশ। এ সময়ে তার সংসার পরিপূর্ণ থাকার কথা। ভালোবাসার প্রিয় মানুষ স্বামী দেবতার পাশে থাকার কথা। কিন্তু বিধাতার লিখন তো আর খন্ডানো যায় না। মেনে নিতে হয় ভাগ্যকে। সেটি যতই নির্মম হোক না কেন?
শৈলবালার খুব সকালে ঘুম ভেঙে যায়। প্রয়োজনীয় কাজ সেরে প্রতিদিন ও পুকুরঘাটে বসে। বিশ্বজিতের পছন্দের জায়গা ছিল এটি। তফাৎ এটুকুই ঘাটটি সুন্দর করে সংস্কার করা হয়েছে। এখানে এসে বসলে শৈলবালা স্বামির সান্নিধ্য অনুভব করে। স্বামী দেবতাতুল্য। স্বামীর স্মৃতি স্মরণ করে দিন শুরু করে শৈল।
ফিরে যায় অতীতে। যে দিনগুলো ছিল শুধুই রঙিন। ছুটির দিনে বিশ্বজিৎ প্রায়ই বিভিন্ন ফুলের গাছের চারা নিয়ে আসতো। শৈলকে সাথে করে নিয়ে এসে নিজ হাতে গাছ লাগাতো। শৈল এতদিনে বুঝে গেছে। গাছ লাগানো ওর স্বামীর শখ। বাড়ীর চারপাশ ঘিরে বিভিন্ন গাছ। এখনও ছায়া দিয়ে রাখে শৈলকে।
তেমনি একদিন কৃষ্ণচুড়া, কদম, জারুল গাছ এনে পুকুরের একটু পারে ঘেষে লাগালো। শৈল ও সাহায্য করছিল। কাজ শেষে শৈল যখন যাচ্ছিল হাত ধুঁতে তখন, বিশ্বজিৎ শাড়ির আঁচলটা টান দিয়ে বলে ছিল, জানো তো এটি কি গাছ? এটি কৃষ্ণচুড়া, এটি কদম, এটি জারুল। এতে কি রঙের ফুল ফোটে জানো? শৈল জানালো,
—-জানি।
—-তোমার সিঁথির সিদুরের রঙের মতো লাল ফুল ফোটে কৃষ্ণচুড়ায়। পুকুরের জলে এর প্রতিচ্ছবি দেখবে আর আমার কথা ভাববে।
—তুমি পাশে বসে থাকলে জলে কেন দেখবো? তোমার চোখের স্বচ্ছ তারায় দেখবো রঙিন ফুলের ছায়া। আর তাছাড়া, তুমিই আমার ফুল। আমার সারাজীবনের অলংকার। চলো এবার যাই। সন্ধ্যা হয়ে এলো।
কোলজুড়ে তখন সুবোধ। দীদার সাথেই কাটে ওর বেশীরভাগ সময়। তাই ওদের সময় কাটাতে অসুবিধা হয় না। কত জ্যোৎস্না রাত কেটে গেছে এ পুকুর ঘাটে। পুকুরে পদ্ম ফুটতো বেশ। পূজোর জন্য শৈল সকালে পদ্ম তুলে আনতো। শাশুড়ির সাথে বসে পূজো করতো। কিভাবে সংসার ও অন্য কাজগুলো করতো সেগুলো খুব খেয়াল করতো।
শৈলর ভিতরে একটা কথা সারাক্ষণ প্রতিধ্বনিত হতো। “না জানা বা না পারার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই, অহং বোধ নেই। বরং সব পারি এবং চেষ্টা করলে সব সম্ভব”। এটি ওর ভিতরে গেঁথে ছিল। তাইতো একাএকা এত বড় ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পেরেছে এখনও। অভাবের মুখ দেখতে হয়নি। একমাত্র পুত্র সন্তানের ও কোনো কিছুর অভাববোধ হতে দেয়নি।
অভাব শুধু প্রিয় ও আপনজনের। আর কিছুর নয়। এখন বর্ষাকাল। এই সময় প্রচুর কৃষ্ণচুড়া ফোটে। কদম, জারুল, হাসনাহেনা ফুটে। সন্ধ্যার পর হাসনাহেনার গন্ধতে কেমন একটা মাদকতা থাকে। হাসনাহেনা গাছ বিশ্বজিৎ ও লাগিয়েছিল। পরে শৈল আরো এনে লাগিয়েছে স্বামীর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য।
হাসনাহেনা গাছ লাগানোর কিছুদিন পর যখন ফুল ফুটেছিল। সন্ধ্যায় শৈল এসেছিল গন্ধ শুকতে শুকতে। বিশ্বজিৎ হাত ধরে টেনে নিয়ে এসেছিল আর বলেছিল,
—-খবরদার শৈল হাসনা হেনা ফুলের গন্ধে সন্ধ্যার পর এখানে একা আসবে না। এ ফুলের সুগন্ধ্যে সাপ থাকে গাছের ঝোঁপে। শৈল ভয়ে জড়িয়ে ধরেছিল বিশ্বজিৎকে। বিশ্বজিৎ খুশি হয়ে বলেছিল,
—- হ্যাঁ, এভাবেই আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখবে। সাপ দেখতে আসার দরকার নেই।
আহ্লাদে আটখানা হয়ে শৈল বলেছিল,
—– এ ছাড়া আর বুঝি কোনো কাজ নেই?
——নেই তো? তুমিই আমার সব কাজ, সব প্রয়োজন।
এ সব কথা ভাবতে ভাবতে অনেক বেলা গড়িয়ে গেছে শৈল খেয়াল করেনি। শুধু অনুভব করলো চোখের কোণ বেয়ে পানি ঝরছে। ইচ্ছে করেই হাতে নিলো কয়েকফোঁটা পানি। হাতের চোখের পানি আর চোখের পানিতে পুকুরপাড়ে ফুটে থাকা কৃষ্ণচুড়ার প্রতিচ্ছবি। চোখের পানি এখন লাল। টকটকে সিঁদুরের মতো লাল।
তবে যে শুনে এসেছে সারাজীবন চোখের পানের রঙ নেই, কোনো আকার নেই। এই তো দুই হাতে চোখের পানি। মনে মনে বিশ্বজিৎকে স্মরণ করে বলে, “দেখো, মাথার উপরের আকাশ ঢেকে আছে লাল টকটকে কৃষ্ণচূড়া আর নীল জারুলে। আমার অশ্রুভরা চোখে লাল-নীল সব রঙ ঝাপসা লাগছে। আচ্ছা, চোখের জলের কি নিজস্ব