Home গল্প জলসাঘর (পর্ব ০৫)

জলসাঘর (পর্ব ০৫)

জলসাঘর (পর্ব ০৫)

লেখকঃ সাঈদা নাঈম

পল্লবী চোখ খুলে যাকে দেখছে, পরিষ্কার না চেহারাটা। ওর দিকে ঝুঁকে আছে। পল্লবী অনেক চেষ্টা করেও চিনতে পারছে না। এরমধ্যে আবার কানে গেল, “আম্মা ওঠেন। কি যে অনিয়ম করেন। দুপুরবেলা না খাইয়া ঘুম দিছে। আম্মা ও আম্মা…!” 

হঠাৎ পল্লবী চোখ খুলল, দেখলো সামনে মতির মা দাঁড়িয়ে। এতক্ষণ তাহলে দিবাস্বপ্নে মেতে ছিল। মতির মাকে দেখে জানতে চাইলো কি হয়েছে? মতির মা গড়গড় করে বলে গেল, “না খেয়ে ঘুমাচ্ছেন যে, খাওয়া লাগবে না?” 

“খাবো। চলো।” 

খাওয়া শেষ করে পল্লবী কিছুক্ষণ বাগানে ঘুরে বেড়ালো। প্রায় সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। পল্লবী ভেতরে চলে গেল। নিজের ঘরে গিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। এদিক থেকে বাড়ির পেছন দিকটা দেখা যায়। ওদিকে একটা ঘাটও রয়েছে। হঠাৎ পল্লবীর চোখে একটা ছায়া ধরা পড়লো। ছায়াটা ক্রমেই দক্ষিণ দিকের ঐ ঘরের পেছন দিকে যাচ্ছে। পল্লবী দ্রুত নিচে নেমে আসতে আসতে ছায়াটির অস্তিত্ব নাই হয়ে গেল। পল্লবীর সন্দেহ বেড়ে গেল। আর যাই হোক এটি কারো আত্মা হতে পারে না। কিন্তু কেউ বিশ্বাসও করবে না। যা করার ওকেই করতে হবে। এদিকেই নজর রাখতে হবে।

প্রচণ্ড উত্তেজনায় রাতটি কাটিয়ে দিলো পল্লবী। চারদিকের আঁধার তখনো ভালো করে কাটেনি। চারপাশটা কেমন লাল আর নীল, ধূসর বর্ণ। পল্লবী এসে বারান্দায় দাঁড়ালো। মুকুন্দ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির রূপ দেখে পল্লবী মুগ্ধ। এমন সময় চোখ গেল সেই ঘাটে। কেউ গোসল করছে। একজন না। দুইটা মানুষ দেখা যাচ্ছে। মেয়ে মানুষ। ওর ভেতরটা আৎকে উঠলো। ও কি ভুল দেখছে নাকি বাস্তব! নাকি ঘুমিয়ে আছে। নিজের হাতে চিমটি কাটলো। অনুভূত হলো। এর মানে জেগে আছে। তাই এখনি সুযোগ…. পল্লবী চুপিসারে সেই ঘাটে এসে পৌঁছলো। মেয়ে দু’টো পেছন ঘুরে ছিল। পল্লবীকে দেখতে পায়নি। হঠাৎ পেছনে একটা শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখে কেউ একজন দাঁড়িয়ে। হতবাক দু’জন। পল্লবী আর চুপ থাকতে পারলো না। 

“তোমরা কারা? এখানে কি করছো? কেমন করে এলে?” 

দু’জন প্রায় বাকরুদ্ধ। পল্লবী বলল, “কি ব্যাপার কথা বলছো না কেন? কে তোমরা?” 

এবার দু’জনের একজন মুখ খুললো, “প্লিজ আস্তে বলুন। কেউ শুনলে সমস্যা হবে।” 

“সমস্যা! কিসের সমস্যা? তোমরা এখানে কি করছো?” 

“আপনাকে সব বলছি, আপনি একটু শান্ত হন।” 

“সব বলছি। কি সব? কি রহস্য? এখানে এলে কীভাবে?” 

“আমরা এখানেই থাকি।” 

পল্লবী যেন আকাশ থেকে পড়লো। “এখানে থাকো মানে? কোথায়?” 

ওরা হাত দিয়ে জলসাঘরটি দেখিয়ে দিলো। 

“কীভাবে? ওটা তো তালাবদ্ধ। তাছাড়া শুনেছি ওখানে নাকি আত্মা…..!” 

“আপনি আমাদের সাথে ভেতরে চলুন সব বলছি। আলো ফুটে উঠছে, কেউ দেখলে আমাদের সর্বনাশ হবে দিদি।”

পল্লবীর কেন জানি না দিদি ডাকটা শুনে মায়া লাগলো। এছাড়া কৌতুহলতো আছেই। তাই ওদের পেছন পেছন জলসাঘরে গেল।

বিশাল বড় ঘর। মেঝেতে মার্বেল, গ্রানাইটের কারুকাজ করা। দেয়ালের পোলেস্টার কোথাও কোথাও খসে পড়েছে। ভেতরে একটি দড়ি টানানো, তাতে কাপড় রাখা। আর রয়েছে অনেক বই। বুঝতে বাকি রইলো না মেয়ে দু’টি শিক্ষিত। বইগুলো ওদের। ঘরের এককোণায় শতরঞ্চি গুটিয়ে রাখা। একটি স্টোভের চুলা। মেয়ে দু’টি নিঃশব্দে চলাফেরা করছে। তারপর পল্লবীর কৌতুহলী দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে একজন বলল, “ভাবছো তো এখানে কীভাবে আমরা? গত দুইবছর হলো আমরা এখানে থাকছি। গোপনে। কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না। আমরা দুইবোন, মা বাবা গত হয়েছে। এছাড়া আমাদের আর কোনো পথ খোলা ছিলো না। কিন্তু  মায়ের দিব্যি বলছি, আমরা যখন দেখলাম তোমরা এসেছো, আমরা চলে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা তো দিনের বেলায় এ গ্রামে চলাফেরা করতে পারি না। আমরা লুকিয়ে এখানে আসি আবার ভোর হতে না হতেই শহরের দিকে চলে যাই।” 

পল্লবী এবার প্রশ্ন করলো, “কিন্তু কেন? লোকচক্ষুর আড়ালে কেন তোমরা? তোমরা কি…?” 

“ছিঃ দিদি! যা বোঝাতে চাইছো আমরা তা নই। আমরা শহরে যাই। পড়াশোনা করি, টিউশনি করি। রাত হলে সবার অলক্ষ্যে এখানে ফিরে আসি।” 

“কেন লুকিয়ে আসতে হয়? তোমাদের বাড়িঘর?” 

“সব ছিল। এখন কিছু নেই। বাবার এত ঋণের বোঝা ছিল যে বাড়িঘর সব ডুবে গেছে।” 

“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার মাথা কেমন যেন করছে।” 

“দিদি আমি রমা, ও আমার ছোট বোন সামা। আমাদের পরিবারকে সমাজ থেকে একঘরে করে রেখেছিল। আমার বাবারই কারণে। ঘরে আগুন লেগে মা- বাবা দু’জনেই পরপারে চলে গেলেন। রয়ে গেলাম দুই বোন। আমাদেরকে গ্রাম ছাড়ার নোটিশ দিলো পঞ্চায়েত। কোথায় যাই বলো? যেখানেই যাবো শেয়াল কুকুরের মতো ……এরপর? আমরা গ্রাম ছেড়ে কোথায় যাবো? এ কথা ভাবতে ভাবতেই মাথায় এলো বুদ্ধি। আমরা পুরোনো জমিদার বাড়িতে থাকবো। ভয়ে এ দিকটায় কেও আসে না। একটু সাবধানে চলাফেরা করতে পারলে এটাই হবে আমাদের নিরাপদ স্থান। প্রথম প্রথম আমরাও ভয় পেতাম। এখন আর পাই না।” 

পল্লবী তখন বলল, “ভয় পাও না, তবে ভয় পাওয়ায়, তাইতো?” 

“কি করবো দিদি? কেউ জানতে পারলে আমাদের গ্রাম ছাড়তে হবে। তাই এদিকে যেন কেউ না আসে তাই মাঝে মধ্যে একটু…।” 

পল্লবী বলল বাকিটা, “ঘুঙুর পায়ে হাঁটো, আলো জ্বালো, শাঁখ বাজাও ….।” 

দু’বোন মাথা নিচু করে আছে। তারপর বলল, “বিশ্বাস করো আমরা চলে যেতাম কিছুদিনের মধ্যে। এতদিন এ বাড়িতে কেউ ছিল না বলেই থাকতে পেরেছি। কিন্তু কেউ থাকা অবস্থায় লুকিয়ে থাকা অনেক কষ্ট। তোমরা এখানে আসার পর থেকে আমরা একদিনও রান্না করিনি।” 

“খেয়েছো কি তাহলে?” 

“শুকনো খাবার, বাড়ি ফেরার পথে নিয়ে আসি।” 

“এখন তাহলে কী করবে? আমি তো তোমাদের দেখে ফেললাম।” 

“দিদিগো তোমার পায়ে ধরি, আজকের দিনটা সময় দাও আমরা শহরে একটা ব্যবস্থা করবো। কথা বলেছি কয়েক জায়গায়। কাউকে বলো না আমাদের কথা।” 

“এতেই কি সমাধান হবে?” 

“করতে হবে, না করে উপায় নেই।” 

“বাড়িটি আমার শ্বশুর মশায়ের। একটি সিদ্ধান্ত তো আমিও নিতে পারি।” 

“দিদি আমাদের পানিতে ফেলো না গো।” 

পল্লবী উঠে দাঁড়ালো। রমাও সাথেসাথে দাঁড়িয়ে বলল, “দিদি আমরা আজ রাতেই চলে যাবো।” 

পল্লবী ওদের শুধু বলল, “ভয় নেই, দিদি বলে ডেকেছো, ক্ষতি করবো না। তবে লুকিয়ে যেন ঘুঙুর পায়ে হাঁটতে না হয় সে ব্যবস্থা করবো।”

দু’বোন কি বুঝলো পল্লবী জানে না। তবে পল্লবী জানে ওকে কি করতে হবে। পল্লবী ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এতক্ষণে বাইরের আলো ফুটে উঠেছে। পুবদিকে সূর্য উঁকি দিচ্ছে নতুন একটি দিনের প্রত্যাশায়। 

যে দিনটি হবে আলোকজ্জ্বল। সাদা শিউলি ফুলের মতো শুভ্র। 

 

সকল পর্বের লিংক নিম্ন দেওয়া হয়েছে
====================

জলসাঘর (পর্ব ০১)

জলসাঘর (পর্ব ০২)

জলসাঘর (পর্ব ০৩)

জলসাঘর (পর্ব ০৪)

Exit mobile version